নন্দিতা সাহা
প্রাণ ভোমরা
নন্দিতা সাহা
চোখ। ফুলের পাপড়ির মতো নরম আমাদের চোখ দুটি। ঈশ্বর নিখুঁতভাবে তৈরী করেছেন এই চোখ সুন্দর পৃথিবী দেখবার জন্য। দুই চোখ দিয়ে দেখি আলো, আকাশ,বনানী সুন্দর ফুটফুটে মানুষ, সহজ সরল সম্পর্ক, দেখি স্নেহ শ্রদ্ধা সম্মান ভালোবাসা। আনন্দে দুই চোখের মনি আমাদের জ্বলজ্বল করে, খুশিতে হাসে, চঞ্চল হয়ে লম্ফঝম্প করে।
অথচ হঠাৎ এই দুই চোখ আজ স্তিমিত, নয়ন সরসীতে আতঙ্কের ছায়া, চিন্তায় নয়ন তারা দুটো স্থির। চোখের সামনে চাপ চাপ কালো অন্ধকার। একি শুরু হলো আমাদের সমাজে!! এমন সমাজ তো আমরা কোনদিন দেখতে চাইনি।!কেবল পাপ আর পাপ! ধর্ষণ! খুন! সবচাইতে দুঃখের, লজ্জার, পাপীরা বিন্দাস ঘুরে বেড়াচ্ছে নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে।
কেউ কি নেই তাদের শাস্তি দেবার??? নিশ্চয়ই আছে। যুগে যুগে নারী অপমানিত হয়েছে কিন্তু মানুষ চুপ করে থাকেনি। উঠে এসেছে কোন না কোন যোগ্য ব্যক্তি। সীতা হরণ! থেমে থাকে নি কেউ, এক ফোটা কাঠবিড়ালি পর্যন্ত ছুটে এসেছে।সেও চেয়েছে যুদ্ধ হোক,দোষী শাস্তি পাক। যুদ্ধ হলো শাস্তি হলো রাবণের। যুগের পরিবর্তন হলো। সব পঙ্কিলতা দূর করে আবার গড়ে উঠল স্বচ্ছ সুন্দর সমাজ।
দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মতো লজ্জার ঘটনা ঘটলো। থেমে থাকে নি কেউ। আবার যুদ্ধ হল অপমানের প্রতিশোধ নিলো, দোষীদের মৃত্যু হল, আবার যুগের পরিবর্তন। সে ছিল ত্রেতা এবং দ্বাপর যুগ। কিন্তু এই কলি যুগে কি দোষীর শাস্তি হবে! বিচার পাবে ধর্ষিতা নারী যে মৃত্যুলোকে পাড়ি দিল শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন নিয়ে!
দৃঢ়বিশ্বাস, নিশ্চয়ই পাবে। চিরকাল অশুভ শক্তির পরাজয় হয়েছে, হবে। দুই চোখে শোকের কালো ছায়া থাকলেও আজ চোখে জ্বলে উঠেছে ক্রোধের আগুন, আকাশ সমান ক্রোধ। এই আগুন নেভে না, নিভ তে দেব না আমরা। এই মুহূর্তে কেবল মুখে কাপড় বেঁধে নয়, আরও সোচ্চার হতে হবে আমাদের। দোষীদের ভেঙে তছনছ করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে, এতোটুকু বীজ রাখা চলবে না।
এইপ্রসঙ্গে একটি কথা। আমি দেখেছি অনেকে কেবল পুরুষ জাতি পুরুষ জাতি বলে কটুক্তি করে চলেছে, আমি কিন্তু সহমত নই। আমি পুরুষ দের বেষ্টনীতে বড় হয়েছি, বাবা কাকা জ্যাঠা দাদা, এরা তো নমস্য। এরা তো পুরুষ। তাই পুরুষ নয় , অভয়া কান্ডে যারা জড়িয়ে আছে তাদের পিশাচ,দানব, রাক্ষস বলাই আমার মনে হয় ঠিক। গল্পে দৈত্য দানব ভূত পিশাচ অনেক পড়েছি। মনে হতো এসবই কল্পনা, কিন্তু এখন দেখছি এই দৈত্য দানব রাক্ষস সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে, রাতের অন্ধকারে তারা মানুষের শরীর ছিঁড়ে ফালা ফালা করে, পৈশাচিক আনন্দে মেতে ওঠে ।
এই পিশাচ দানবের দলে নারীজাতি ও আছে বৈকি। এরাই পিশাচিনী, প্রেত্নী,রাক্ষসী।
রূপকথার গল্পে জলের তলায় লুক্কায়িত খাঁচায় পাখি র মধ্যেই রাক্ষসদের প্রাণ ভোমরা থাকতো। সেটিকে মারতে পারলেই নাকি সকল রাক্ষস জাতি ধ্বংস হত। সেই প্রাণ ভোমরা আমাদেরও খুঁজে বার করতে হবে, তবেই পাপের এবং পাপীর ধ্বংস।
মৃত্যুদণ্ড ছাড়া কোন দণ্ডই উপযুক্ত হতে পারেনা। এই সুন্দর পৃথিবীতে দৈত্য দানব সম এই মানুষদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।
আজ আমরা জেগে উঠেছি । ধনী গরিব জাতি ধর্ম নির্বিশেষে জেগে উঠেছে মানুষ।এই গর্জন থামবে না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জন থামেনা। ইতিহাস সাক্ষী
।
রাজা কিংবা রানী প্রজার অভিভাবক, প্রজার রক্ষক। সেই অভিভাবক যদি রক্ষক হয়েও ভক্ষক হয় সেও কিন্তু ছাড় পাবে না এই শাস্তি থেকে। অর্থবল, পদাধিকার বল, বাহু বল চাতুরি ---------জনরোষের সামনে মুখ থুবড়ে পড়বে। বারবার একই পাপের একই নৃসংশতার পুনরাবৃত্তি আর নয়।
প্রমাণ!!! এই কথাটি শুনলেই হাসি পায় বড্ড।আজও শুভ বুদ্ধির মানুষ আছে। তাদের একটি প্রখর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে। সুবুদ্ধি সম্পন্ন সু চিন্তিত সৎ মানুষের এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নির্ভেজাল সত্যিটাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সেটি সবচাইতে বড় প্রমাণ।।
এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সামনে, তথাকথিত স্বাক্ষর কাগজ কলম বেঞ্চ দিনের পর দিন দুই পক্ষের প্রশ্ন সওয়াল জবাব নিরুত্তর হয়ে যায়, প্রহসনে পরিণত হয় ।
অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে । এই খুন যে করেছে, ধর্ষণের মতো নেক্কারজনক অপরাধ পাপ যে করেছে, পাপী কে যে আড়াল করার চেষ্টা করছে, চুপ করে আছে তাদেরও কিন্তু শাস্তি প্রাপ্য। তারাও একই দোষে দোষী। তাদের জন্য বড় লজ্জা হয়, বড় করুণা হয়। সুন্দর পরিচ্ছন্ন জীবন ছেড়ে তারা নর্দমার কীটের মত আবর্জনায় মুখ গুঁজে আছে।
ধৃতরাষ্ট্রর স্নেহে অন্ধ এবং মাতা গান্ধারীর অন্ধ সেজে থাকবার কারণেই কৌরবদের পতন। ধৃতরাষ্ট্র স্নেহে অন্ধ না হয়ে, মাতা গান্ধারী যদি চোখ দুটো মেলে ছেলেদের কুকীর্তি দেখতেন, শাসন করতেন , তবে হয়ত শেষ রক্ষা হত। রাজা রানী প্রশাসন মন্ত্রী সৈন্য সামন্ত যেন সেই ভুলটা করবেন না। নইলে খুব শিগগিরই ক্রোধের আগুন কিন্তু মশাল হয়ে জ্বলে উঠবে, উঠতে বাধ্য হবে।
আশা রাখি বিচারের বাণী আর নীরবে নিভৃতে কাঁদবে না। বিচারব্যবস্থা সোচ্চার হবে, শাস্তি হবে পাপ এবং পাপীদের। সব পঙ্কিলতা মুছে সুন্দর যুগের শুরু হবে।
দুঃখ তিলোত্তমাকে আমরা পৃথিবীতে ধরে রাখতে পারলাম না। আমাদের মাথা তার সামনে ঝুঁকে যায়। বড় লজ্জা হয়। লজ্জা হয় আমাদের অব্যবস্থার জন্য। রাজা রানী, মন্ত্রী, সরকার প্রশাসন যদি শক্ত হতো,যদি তারা কেবল নিজেদেরকে ভালো না বেসে দেশ এবং জনগণ কেও ভালোবাসতো, তবে হয়তো তিলোত্তমা আজকের সূর্যোদয়, সুন্দর সকাল দেখতে পেত।
আবারো যদি বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে, ভয় কি!আছে তো জনগণ,জনগণের জন্য সরকার, জনগণ নিয়ে ই দেশ।
একশো মুষ্ঠী যখন এক হয়, সেটি বজ্র মুষ্ঠীতে পরিণত হয়। তার শক্তি, তার ক্ষমতা ইতিহাসে লেখা আছে।

পাঠকের মতামতঃ